কোন ওয়েবসাইট তৈরি করতে গেলে ওয়েবসাইট ডিজাইন করার পাশাপাশি ওয়েবসাইটের আরও কিছু কাজ করা লাগে। ওয়েবসাইট ডিজাইন করাই ওয়েবসাইট বানানোর ক্ষেত্রে একমাত্র কাজ নয় বরং ওয়েবসাইটের সার্ভারসহ ওয়েবসাইটের কাঠামো তৈরি ওয়েবসাইট তৈরির ক্ষেত্রে অনেক বড় একটি অংশ বহন করে। তাই ওয়েব ডিজাইনারের পাশাপাশি একটি ওয়েবসাইটের কাজের জন্য ওয়েব ডেভেলপারের প্রয়োজন পড়ে এবং একজন ফুল স্ট্যাক ডেভেলপারের কাজ হল ওয়েব ডিজাইন ও ওয়েব ডেভেলপমেন্ট – দুটোর কাজই সম্পন্ন ও সমন্বয় করা।
একজন ফুল স্ট্যাক ডেভেলপার কোথায় কাজ করেন?
ফুল স্ট্যাক ডেভেলপার হলে আপনার কাজের ক্ষেত্র শুধুমাত্র ওয়েবসাইটের কাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বর্তমানে ইন্টারনেটের যুগে সবধরনের প্রতিষ্ঠানেরই ওয়েবসাইট প্রয়োজন হয়। তাই ফুল স্ট্যাক ডেভেলপারের কাজের ক্ষেত্র একটি নির্দিষ্ট জায়গায় সীমাবদ্ধ হলেও কাজের ধরনে বেশ বৈচিত্র্য থাকে এবং এক্ষেত্রে সৃষ্টিশীলতা দেখানোর বেশ সুযোগ থাকে। বৈচিত্র্যের সাথে কাজ করতে চান এবং সৃষ্টিশীল কাজের প্রতি আগ্রহী হলে ফুল স্ট্যাক ডেভেলপার হিসেবে আপনি কাজ করতে পারেন।
একজন ফুল স্ট্যাক ডেভেলপার কী ধরনের কাজ করেন?
প্রথমেই বলে নেওয়া হয়েছে একজন ওয়েব ডেভেলপারের কাজ ওয়েব ডিজাইনারের থেকে আলাদা। ওয়েব ডিজাইনার সাধারণত ওয়েবসাইটের কারুশৈলী, ওয়েবসাইটের রংবিন্যাস এবং প্রতিটি পেজের ইন্টারফেস কেমন হবে সেই ধরনের কাজগুলো সম্পাদন করেন। মোদ্দাকথা, ওয়েবসাইটের বাহ্যিক অবয়ব তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয় একজন ওয়েব ডিজাইনারকে। ওয়েব ডিজাইনার ও ওয়েব ডেভেলপার – উভয় ক্ষেত্রেই কোডিং ও প্রোগ্রামিং –এর বেশ ভালো জ্ঞান থাকতে হয়। ওয়েব ডেভেলপারের কাজ হয় ওয়েবসাইটের অভ্যন্তরীণ কাজ সম্পাদন করা। একটি ওয়েবসাইটের কাঠামো কেমন হবে, সার্ভারের কাজ সম্পাদন করা থেকে শুরু করে ব্যবহারকারীদের সুবিধার জন্য সার্ভারের সমস্যা সমাধান করা এবং বিভিন্ন অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহারের মাধ্যমে ওয়েবসাইটের কাজ সহজ করা ও কাঠামো দাঁড় করানোসহ ওয়েবসাইটের কারুশৈলী ও নকশা ঠিক করার দায়িত্ব একজন ফুল স্ট্যাক ডেভেলপারের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। ফুল স্ট্যাক ডেভেলপার হলে আপনার কাজের ধরন হবে নিম্নরূপ –
১। ওয়েবসাইটের কাঠামো তৈরি করা এবং মেরামত করা সাথে ওয়েবসাইটের বাহ্যিক অবয়ব ঠিক করা। অর্থাৎ ওয়েব ডেভেলপমেন্ট ও ডিজাইন – উভয়ের কাজই সম্পন্ন করা ও সমন্বয় করা।
২। সার্ভারের কাজ ঠিক করার মাধ্যমে ওয়েবসাইটের কাজ সহজ করা ও সমন্বয় করা।
৩। ওয়েবসাইট কোন সমস্যার সম্মুখীন হলে সেই সমস্যার সমাধান করা।
৪। ওয়েবসাইটের ফ্রন্ট এন্ড ও ব্যাক এন্ডের কাজ আপনাকে করতে হবে। ফ্রন্টএন্ড মানে ওয়েবসাইটের বাহ্যিক অবয়ব। এক্ষেত্রে ওয়েবসাইটের বাহ্যিক অবয়বের ক্ষেত্রে কাঠামো ঠিক রাখার কাজ করতে হবে আপনাকে। অপরদিকে ব্যাকএন্ড-এর ক্ষেত্রে সাধারণত সার্ভার, অ্যাপ্লিকেশন ও ডাটাবেজ – এই তিনটি বিষয় নিয়ে কাজ করা লাগে। সার্ভারে সাধারণত ডাটাবেজ থাকে যেই ডাটাবেজে আপনার সব তথ্যগুলো জমা করা থাকে। ফ্রন্টএন্ড ও ব্যাকএন্ড দুই ধরনের কাজই একসাথে করতে চাইলে বর্তমানে ওয়ার্ডপ্রেস-এর মাধ্যমে তা করা সম্ভব। ফুল স্ট্যাক ডেভেলপার হিসেবে ওয়েবসাইটের তথ্য ইনপুট বা প্রবেশসহ সার্ভারের কাজ ও অ্যাপ্লিকেশনের কাজ আপনার করা লাগবে এবং একইসাথে ওয়েব ডিজাইনের কাজও আপনাকে করতে হবে।
৫। ওয়েবসাইট মনিটরিং-এর কাজ করতে হবে আপনাকে।
৬। সফটওয়্যার তৈরির ক্ষেত্রে সমগ্র প্রক্রিয়াই আপনাকে দেখভাল করতে হবে ও সম্পন্ন করতে হবে। একজন ফুল স্ট্যাক ডেভেলপার সব রকমের প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজের সাথে পরিচিত।
৭। কী ধরনের হার্ডওয়্যার ও অপারেটিং সিস্টেম লাগবে এবং কোন গ্লিচ বা সমস্যা আছে কিনা সে ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হয় একজন ফুল স্ট্যাক ডেভেলপারকে।
৮। ফায়ারওয়াল ও পারমিশন ব্যবস্থাপনার কাজ করা।
৯। অ্যাপাচি(Apache) ও এনগিঙ্কস(Nginx)-এর মত সার্ভার প্রোগ্রামগুলোর ব্যবস্থাপনা করা সার্ভিং অ্যাপসগুলোর জন্য।
১০। প্রাথমিক পর্যায়ের শেল স্ক্রিপ্ট করা।
১১। ফুল স্ট্যাক ডেভেলপারকে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ই-কমার্সের প্রক্রিয়া সম্পূর্ণরূপে তৈরি করতে হয় এবং সম্পন্ন করতে হয়। এক্ষেত্রে ই-কমার্স লেনদেনের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হওয়ায় ফুল স্ট্যাক ডেভেলপারকে নিয়মিত তা দেখভাল করতে হয় কারণ এ ব্যাপারে কোন সমস্যার সৃষ্টি হলে তা প্রতিষ্ঠানের জন্য ক্ষতি ডেকে আনতে পারে।
১২। ওয়েবসাইটের নিরাপত্তা(সিকিউরিটি) ও ডাটা প্রটেকশনের (তথ্য নিরাপত্তা) কাজ করতে হবে আপনাকে।
১৩। ওয়েবসাইটের সামগ্রিক আর্কিটেকচার বা গঠন তৈরি করতে হবে আপনাকে।
একজন ফুল স্ট্যাক ডেভেলপারের কী ধরনের যোগ্যতা থাকতে হয়?
১। ফুল স্ট্যাক ডেভেলপার হিসেবে কাজ করতে চাইলে ব্যক্তিগত দক্ষতা বেশি জরুরী। অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকলেও ব্যক্তিগত দক্ষতার উপর নির্ভর করে নিয়োগ দেওয়া হয়ে থাকে। তবে ফুল স্ট্যাক ডেভেলপার হিসেবে কাজ করতে চাইলে যোগ্যতার বিষয়টি প্রতিষ্ঠানসাপেক্ষ হলেও সাধারণত কম্পিউটার প্রকৌশল বিষয়ে ব্যাচেলর ডিগ্রি আছে এমন কাউকেই নিয়োগ দেওয়া হয়। কিছু ক্ষেত্রে কম্পিউটার প্রকৌশল বিষয়ে ডিপ্লোমা ডিগ্রি থাকলেও আপনাকে নিয়োগ দেওয়া হতে পারে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তথ্য প্রযুক্তি বা আইটি, কম্পিউটার প্রকৌশল, টেলিকমিউনিকেশন প্রকৌশল বিষয়ে ডিগ্রির কথা উল্লেখ করা থাকে। এর পাশাপাশি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় পুরোনো অভিজ্ঞতা এবং সম্যক ধারণা ও জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লিখিত ডিগ্রির বিষয়টি নিয়োগের জন্য শিথিল করা হয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় নির্দিষ্ট কোন বিষয় নয় বরং শুধুমাত্র ব্যাচেলর বা মাস্টার্স ডিগ্রি থাকলেই আপনার কোডিং ও প্রোগ্রামিং-এর ধারণার উপর ভিত্তি করে আপনাকে নিয়োগ দেওয়া হবে। এক্ষেত্রে বিষয়টি একেবারেই প্রতিষ্ঠানসাপেক্ষ এবং কম্পিউটার প্রকৌশল বিষয়ে ডিগ্রি না থাকলেও নিয়োগ পেতে পারেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ডিগ্রির প্রয়োজনীয়তা না থাকলেও কিছু ক্ষেত্রে কম্পিউটার প্রকৌশল বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রির কথা উল্লেখ করা থাকতে পারে। আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় শুধুমাত্র ব্যাচেলর অব সায়েন্স কিংবা ব্যাচেলর অব সায়েন্স ইন ইঞ্জিনিয়ারিং (যে কোন বিষয়)-এর কথা উল্লেখ করা থাকে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে।
২। ফুল স্ট্যাক ডেভেলপার হিসেবে কাজ করার ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নিয়োগ পাওয়ার জন্য ন্যূনতম ১ বছরের অভিজ্ঞতা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাধ্যতামূলকভাবে উল্লেখ করা থাকে। কিছু ক্ষেত্রে ৩ থেকে ৬ বছরের অভিজ্ঞতা প্রয়োজনীয় হতে পারে। সাধারণত ২ থেকে ৩ বছরের অভিজ্ঞতা থাকলেই এক্ষেত্রে ফুল স্ট্যাক ডেভেলপার হিসেবে নিয়োগ পাওয়া যায়।
৩। ফুল স্ট্যাক ডেভেলপার হিসেবে কাজ করতে চাইলে নারী বা পুরুষ প্রার্থী নিয়োগের কথা আলাদাভাবে সাধারণত উল্লেখ করা থাকতে পারে কিন্তু সাধারণত কোন ধরনের কোন বাধ্যবাধকতা এক্ষেত্রে নেই। নারী এবং পুরুষ উভয়ের জন্যই কাজটি সমান ভার ও অর্থ বহন করে বিধায় নারী-পুরুষ উভয়েই ফুল স্ট্যাক ডেভেলপার হিসেবে কোন প্রাধান্য ছাড়াই কাজ করতে পারেন। তবে কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় রাতভর কাজ করতে হবে বিধায় প্রতিষ্ঠান শুধুমাত্র পুরুষ প্রার্থী নিয়োগের কথা উল্লেখ করে থাকে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে।
৪। ফুল স্ট্যাক ডেভেলপার হিসেবে কাজ করতে চাইলে অভিজ্ঞতা বেশ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কিন্তু নিয়োগের জন্য সাধারণত বয়সসীমা গুরুত্বপূর্ণ কোন বিষয় নয়। কিছু ক্ষেত্রে তবুও ২৮ থেকে ৩৫ বছরের বয়সসীমার কথা উল্লেখ করা থাকতে পারে।
একজন ফুল স্ট্যাক ডেভেলপারের কী ধরনের দক্ষতা ও জ্ঞান থাকতে হয়?
১। ফুল স্ট্যাক ডেভেলপার হিসেবে কাজ করতে গেলে বিভিন্ন ধরনের অ্যাপ্লিকেশনের কাজ জানতে হবে আপনাকে। এক্ষেত্রে সফটওয়্যার বিষয়ে আপনার সম্যক ধারণা থাকতে হবে।
২। এইচটিএমএল-৫, সিএসএস-৩, ওয়ার্ডপ্রেস, অ্যাজাক্স থেকে শুরু করে পিএইচপি, লারাভেল, এপিআই, জেএসওএন, রিঅ্যাক্ট জাভাস্ক্রিপ্ট সহ সব ধরনের প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ, সফটওয়্যার ও অ্যাপ্লিকেশনের কাজ জানতে হবে। এক্ষেত্রে পাইথন, রুবি, জাভা, ডটনেট – এই প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজগুলো উল্লেখযোগ্য।
৩। ফ্রন্টএন্ড ও ব্যাকএন্ড-এর কাজ করার ক্ষেত্রে সম্যক ধারণা থাকতে হবে এবং নতুন জ্ঞান আহরণের জন্য নিয়মিত ইন্টারনেটে খোঁজ রাখতে হবে নতুন কিছু করার জন্য। এক্ষেত্রে ওয়েব ডিজাইনের জন্য ফ্রন্টএন্ড ও ওয়েব ডেভেলপমেন্টের জন্য ব্যাকএন্ড – উভয় ক্ষেত্রেই গভীর ধারণা থাকতে হবে আপনার।
৪। সৃষ্টিশীল হওয়া জরুরী। ওয়েবসাইট তৈরি করার ক্ষেত্রে আপনার সৃষ্টিশীলতা এবং অ্যাপ্লিকেশন ও কোডিং দক্ষতার পরিচয় দিতে পারলে পরবর্তীতে ক্যারিয়ারে অগ্রগতির জন্য তা সুবিধাজনক হয়।
৫। জেড, ইজেএস, জিনজার মত সার্ভিং সাইড ল্যাঙ্গুয়েজগুলো নিয়ে সম্যক ধারণা থাকতে হবে।
৬। কোডিং বিষয়ে যথার্থ ধারণা থাকতে হবে।
৭। গিট, মারকিউরিয়াল অথবা এসভিএন-এর মত কোড ভার্শনিং টুল নিয়ে জানতে হবে।
একজন ফুল স্ট্যাক ডেভেলপারের মাসিক আয় কেমন?
ফুল স্ট্যাক ডেভেলপারের মাসিক আয় কাজ, অভিজ্ঞতা ও প্রতিষ্ঠানসাপেক্ষ। সাধারণত একজন ফুল স্ট্যাক ডেভেলপারকে নিয়োগের পরে মাসিক ৫০ হাজার টাকা থেকে ৭০ হাজার টাকা দেওয়া হয়।
একজন ফুল স্ট্যাক ডেভেলপারের ক্যারিয়ার কেমন হতে পারে?
বিষয়টি একেবারেই প্রতিষ্ঠানসাপেক্ষ। তবে ফুল স্ট্যাক ডেভেলপার হিসেবে কাজ শুরু করার পরে পরবর্তীতে সিনিয়র ফুল স্ট্যাক ডেভেলপার হিসেবে নিয়োগ পাওয়া যায়। ফুল স্ট্যাক ডেভেলপার পদ থেকে সর্বোচ্চ ওয়েব ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজার এবং হেড অব ওয়েবসাইট ম্যানেজমেন্ট পদ পর্যন্ত আপনি উন্নীত হতে পারবেন।