নিরাময় করা সম্ভব নয় এমন রোগীর চিকিৎসা করে থাকেন একজন প্যালিয়াটিভ কেয়ার বিশেষজ্ঞ। প্যালিয়াটিভ কেয়ার বিশেষজ্ঞের কাজের প্রাথমিক বিবরণ শুনে মনে হতে পারে এটি একটি অর্থহীন কাজ। তবে চিকিৎসাশাস্ত্রের এ বিশেষায়িত বিভাগে সাধারণত নিরাময় করা সম্ভব নয় এবং সুস্থ হওয়া প্রায় অসম্ভব এমন ব্যক্তিদের নিয়ে কাজ করা গত কয়েক বছরে বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে মরণব্যাধির সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায়।
একজন প্যালিয়াটিভ কেয়ার বিশেষজ্ঞ কোথায় কাজ করেন?
সাধারণত টারশিয়ারি পর্যায়ের হাসপাতালে একজন প্যালিয়াটিভ কেয়ার বিশেষজ্ঞ কাজ করে থাকেন। সরকারি এবং বেসরকারি – দুই ধরনের হাসপাতাল বা প্রতিষ্ঠানেই প্যালিয়াটিভ কেয়ার বিশেষজ্ঞ নিযুক্ত থাকেন। এটি চিকিৎসাশাস্ত্রের বিশেষায়িত একটি অংশ হওয়ায় বেশ অভিজ্ঞতা ও চিকিৎসাশাস্ত্রের বিশেষায়িত ডিগ্রি প্রয়োজন হয়। এক্ষেত্রে একজন প্যালিয়াটিভ কেয়ার বিশেষজ্ঞ কর্মক্ষেত্র হতে পারে নিম্নলিখিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে –
১। টারশিয়ারি পর্যায়ের সরকারি ও জাতীয় হাসপাতাল (অর্থাৎ যেখানে আইসিইউ বা নিবিড় পর্যবেক্ষণ ইউনিট আছে)।
২। সরকারি ও বেসরকারি কিছু মেডিকেল কলেজ।
৩। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।
৪। বড় ধরনের বেসরকারি হাসপাতাল যেখানে আইসিইউ বা নিবিড় পর্যবেক্ষণ ইউনিট আছে।
একজন প্যালিয়াটিভ কেয়ার বিশেষজ্ঞ কী ধরনের কাজ করেন?
প্যালিয়াটিভ কেয়ার বিশেষজ্ঞ হিসেবে আপনাকে সাধারণত নিম্নলিখিত কাজগুলো করতে হবে –
১। নিরাময় সম্ভব নয় এবং সুস্থতার সম্ভাবনা প্রায় নেই এমন ব্যক্তিদেরকে নিয়ে কাজ করেন একজন প্যালিয়াটিভ কেয়ার বিশেষজ্ঞ।
২। শুধুমাত্র রোগী নয় বরং রোগীর নিকটাত্নীয়দেরকেও পরামর্শ দিয়ে থাকেন এবং সাহায্য করে থাকেন একজন প্যালিয়াটিভ কেয়ার বিশেষজ্ঞ যাতে রোগীকে ঘিরে তাদের মধ্যে ক্রমাগত দুশ্চিন্তা, মানসিক চাপ ও হতাশা না বাড়তে থাকে।
৩। কিছু ক্ষেত্রে নিরাময় সম্ভব নয় এমন রোগের শুরুর পর্যায়ের চিকিৎসা দিয়ে থাকেন একজন প্যালিয়াটিভ কেয়ার বিশেষজ্ঞ। যেমন – এইডস, ডায়াবেটিস প্রভৃতি রোগের নিরাময় সাধারণত সম্ভব নয়। এ ধরনের রোগের ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসা দেওয়া হয়ে থাকে যা একজন প্যালিয়াটিভ কেয়ার বিশেষজ্ঞের কাজ।
৪। ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীকে কেমোথেরাপি দেওয়ার পরে যদি শরীরের কোথাও (যেমন – ফুসফুস) পানি চলে আসা তা অপসারণের কাজ করতে হয় একজন প্যালিয়াটিভ কেয়ার বিশেষজ্ঞকে।
৫। দীর্ঘমেয়াদী শারীরিক ব্যথা বা মরণঘাতী আঘাতের চিকিৎসা করতে হয় একজন প্যালিয়াটিভ কেয়ার বিশেষজ্ঞকে।
৬। আইসিইউ এবং জটিল রোগে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার বিষয়ে অন্যান্য দায়িত্বপ্রাপ্ত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের প্রয়োজনীয় সহায়তা ও পরামর্শ দিতে হয় একজন প্যালিয়াটিভ কেয়ার বিশেষজ্ঞকে।
৭। হার্ট ফেইলার, রেনাল ফেইলার, দীর্ঘ সময় ধরে বিকশিত ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারী ডিজিজ (COPD), দীর্ঘ সময় ধরে শরীরে বিকশিত হওয়া ক্যান্সার এবং মরণব্যাধি স্নায়বিক সমস্যার চিকিৎসা প্রদান করতে হয় একজন প্যালিয়াটিভ কেয়ার বিশেষজ্ঞকে।
৮। যথাসম্ভব সময় রোগীকে ভালোভাবে এবং ভালো অবস্থায় বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করতে হয়।
৯। মরণব্যাধিতে আক্রান্ত রোগীকে মানসিক সহায়তা প্রদান করতে হয়।
১০। কিছু ক্ষেত্রে মরণব্যাধিতে আক্রান্ত নয় এমন রোগীদের প্রাথমিক ও মানসিক সহায়তা প্রদান করার কাজ করতে হতে পারে একজন প্যালিয়াটিভ কেয়ার বিশেষজ্ঞকে।
একজন প্যালিয়াটিভ কেয়ার বিশেষজ্ঞের কী ধরনের যোগ্যতা থাকতে হয়?
প্যালিয়াটিভ কেয়ার বিষয়ের উপর বিশেষায়িত ডিগ্রি থাকলেই কেবলমাত্র আপনি প্যালিয়াটিভ কেয়ার বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করতে পারবেন। এক্ষেত্রে প্যালিয়াটিভ কেয়ার বিষয়ে এমডি, এফসিপিএস, এমসিপিএস অথবা ডিপ্লোমা ডিগ্রি থাকলে আপনি প্যালিয়াটিভ কেয়ার বিশেষজ্ঞ হিসেবে নিয়োগ পেতে পারেন। এ ধরনের এমবিবিএস পরবর্তী কোন ডিগ্রি ছাড়া প্যালিয়াটিভ কেয়ার বিষয়ে বিশেষায়িত জ্ঞান অর্জন করা যায় না বিধায় এরকম কোন ডিগ্রি ছাড়া প্যালিয়াটিভ কেয়ার বিশেষজ্ঞ হিসেবে কোথাও নিয়োগ পাওয়া যায় না। নিয়োগ পাওয়ার ক্ষেত্রে সাধারণত পূর্ব অভিজ্ঞতা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অন্যান্য কর্মক্ষেত্রের মত এখানেও অভিজ্ঞতা থাকলে প্রার্থীকে প্রাধান্য দেওয়া হয়।
একজন প্যালিয়াটিভ কেয়ার বিশেষজ্ঞের কী ধরনের দক্ষতা ও জ্ঞান থাকতে হয়?
১। প্যালিয়াটিভ কেয়ারের একটি বিশেষ গুরুত্ব ও বৈশিষ্ট্য হল মরণব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসা করতে হয় কিংবা যতটুকু সময় সম্ভব ভালোভাবে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। এক্ষেত্রে আপনি যদি প্যালিয়াটিভ কেয়ার বিশেষজ্ঞ হতে চান তাহলে আপনাকে অবশ্যই দৃঢ় মানসিকতার হতে হবে।
২। মরণব্যাধিতে আক্রান্ত রোগীরা কিছুদিন পরে মারা যাবেন এটা মেনে নেওয়ার মত মানসিক শক্তি থাকতে হবে। এ ব্যাপারে হতাশায় ভুগলে হবে না।
৩। আবেগী হওয়া যাবে না। মরণব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তি এবং তার আত্নীয়-স্বজন সকলেই অসুস্থতার বিষয়টি নিয়ে আবেগী ও স্পর্শকাতর থাকবেন। এক্ষেত্রে আপনার কাজ যেহেতু হবে তাদের সাথে যোগাযোগ সমন্বয় এবং তাদের মানসিকভাবে শক্তিশালী করা সেহেতু কোনভাবেই আবেগের বশে এঁদের কেউ আঘাত পাবেন এমন কথা বলা যাবে না।
৪। কৌশলী হতে হবে।
৫। প্যারাসেন্টেসিস বা শরীরের কোন অংশ থেকে পানি বের করার প্রক্রিয়ার ব্যাপারে পরিষ্কার ধারণা থাকতে হবে।
৬। এপিডিউরাল ইনফিউশন বা ব্যথা প্রতিরোধের জন্য এক ধরনের অ্যানেসথেসিয়ার বিষয়ে যথেষ্ট ধারণা থাকতে হবে।
৭। নিজের ইচ্ছা না থাকলে চিকিৎসাশাস্ত্রের এই বিভাগের দিকে অগ্রসর না হওয়া ভালো বরং অন্য কোন বিভাগে নিজের ক্যারিয়ার এগোনোর চিন্তা করা উচিত হবে সেক্ষেত্রে।
৮। প্যাথোলজি বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা থাকতে হবে।
৯। নিরাময়অযোগ্য, দীর্ঘস্থায়ী, দীর্ঘ সময় ধরে তৈরি হওয়া মরণব্যাধি বিষয়ে যথেষ্ট ধারণা থাকতে হবে।
১০। এইডস, দ্বিতীয় ও শেষ পর্যায়ের ক্যান্সার এবং ডায়াবেটিসসহ অন্যান্য নিরাময় সম্ভব নয় এমন রোগ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞান অর্জন করতে হবে।
একজন প্যালিয়াটিভ কেয়ার বিশেষজ্ঞের মাসিক আয় কেমন?
আপনি যদি একজন প্যালিয়াটিভ কেয়ার বিশেষজ্ঞ হন সেক্ষেত্রে বেসরকারি ক্ষেত্রে জুনিয়র কনসালট্যান্ট হিসেবে শুরুর দিকে আপনার মাসিক সম্মানী শুরু হতে পারে সাধারণত ৭০০০০ টাকা থেকে। সময় ও অভিজ্ঞতার সাথে আপনার মাসিক আয় বেড়ে এক লাখ টাকা কিংবা তার অধিকও হতে পারে। তবে বিষয়টি কাজ ও প্রতিষ্ঠানসাপেক্ষ।
সরকারি কর্মক্ষেত্রে আপনার মাসিক সম্মানী নির্দিষ্ট করা থাকবে জাতীয় বেতন স্কেল অনুযায়ী। এক্ষেত্রে আপনার মাসিক সম্মানী শুরু হবে ৬ষ্ঠ স্কেল বা ৪৩০০০ টাকা থেকে।
একজন প্যালিয়াটিভ কেয়ার বিশেষজ্ঞের ক্যারিয়ার কেমন হতে পারে?
হাসপাতালের ক্ষেত্রে একজন প্যালিয়াটিভ কেয়ার বিশেষজ্ঞের ক্যারিয়ারের পদবিন্যাস সাধারণত নিম্নলিখিত পদগুলো অনুযায়ী পর্যায়ক্রমে এগোয় –
১। জুনিয়র কনসালট্যান্ট
২। সিনিয়র কনসালট্যান্ট
এক্ষেত্রে নিয়োগের পরে আপনার প্রথম পদ হবে জুনিয়র কনসালট্যান্ট। সাধারণত অল্প অভিজ্ঞতা আছে এবং অন্তত একটি ব্যাচেলর পরবর্তী ডিগ্রি আছে এমন ব্যক্তিদেরকে জুনিয়র কনসালট্যান্ট হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। জুনিয়র কনসালট্যান্ট হিসেবে কাজ করতে হলে অবশ্যই আপনাকে বিশেষজ্ঞ হতে হবে। কিছু সময় অভিজ্ঞতা লাভের পরে এবং নতুন কোন উচ্চ শিক্ষার ডিগ্রি লাভের মাধ্যমে আপনি সিনিয়র কনসালট্যান্ট হিসেবে পদোন্নতি পাবেন। সরকারি ও বেসরকারি উভয় ধরনের হাসপাতালের জন্যই তা প্রযোজ্য।
মেডিকেল কলেজ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে কিংবা যে কোন জায়গায় শিক্ষকতার ক্ষেত্রে আপনার পদবিন্যাস সহকারী অধ্যাপক থেকে শুরু হয়ে সহযোগী অধ্যাপক পদে উন্নীত হওয়ার মাধ্যমে সর্বোচ্চ অধ্যাপক পর্যন্ত যেতে পারে। নিয়মিত পড়াশোনা করা ও পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া একজন প্যালিয়াটিভ কেয়ার বিশেষজ্ঞের জন্য জরুরী।
কোথায় পড়বেন প্যালিয়াটিভ কেয়ার?
এমবিবিএস ডিগ্রি লাভের পরে বাংলাদেশে বিসিপিএস (বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনস) থেকে প্যালিয়াটিভ কেয়ার বিষয়ের উপর এফসিপিএস ডিগ্রি লাভ করা সম্ভব। এছাড়া কয়েকটি সরকারি মেডিকেল কলেজে ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্যালিয়াটিভ কেয়ার বিষয়ের উপর গ্র্যাজুয়েশন পরবর্তী ডিগ্রিগুলো যেমন – ডিপ্লোমা, এমডি প্রভৃতি দেওয়া হয়ে থাকে।